যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো এক বরষায়

যদি মন কাঁদে/তুমি চলে এসো, চলে এসো/এক বরষায়…/এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে/জল ভরা দৃষ্টিতে/এসো কোমল শ্যামল ছায়…।’ প্রিয় কারো উদ্দেশে এই আহ্বান জানিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কিংবদন্তি লেখক, কথার জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ।

হ্যাঁ আজ এই জনপ্রিয় লেখক, পরিচালকের ৭৩তম জন্মবার্ষিকী। বৃষ্টি ছিল তার খুব প্রিয়। একটি উপন্যাসের নামও রেখেছিলেন ‘বৃষ্টিবিলাস’। গাজীপুরের নির্জন জঙ্গলে নিজের গড়া নুহাশপল্লীতে একটি সুন্দর বাংলো গড়ে সেটারও নাম দিয়েছিলেন ‘বৃষ্টিবিলাস’। আজও হয়তো তার কথা মনে করে সকাল থেকে ঝরছে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি।

হুমায়ূন আহমেদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। তার প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ ১৯৭২ সালে প্রকাশের পরপরই তিনি খ্যাতি লাভ করেন। এরপর একের পর এক উপন্যাস লিখে পেয়েছেন অতুলনীয় জনপ্রিয়তা।

তার একটি নতুন বই আর সেই বইয়ে একটি অটোগ্রাফের জন্য বাংলা একাডেমির বইমেলায় তরুণ-তরুণীদের দীর্ঘ লাইন বইপ্রেমীদের স্মৃতিতে অমলিন হয়ে আছে। এ দেশে জনপ্রিয়তায় শীর্ষে থাকা এই লেখক দুই শতাধিক ফিকশন ও নন-ফিকশন বই লিখেছেন।

তার লেখা উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘দেয়াল’, ‘বাদশা নামদার’, ‘কবি’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘লীলাবতী’, ‘গৌরীপুর জংশন’, ‘নৃপতি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘মধ্যাহ্ন’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘দারুচিনি দ্বীপ’, ‘নক্ষত্রের রাত’ ইত্যাদি।

হিমু, মিসির আলীর মতো চরিত্র সৃষ্টি করে লাখো-কোটি পাঠক-ভক্ত তৈরি করেছেন এই কথার জাদুকর। বাংলাদেশে সায়েন্স ফিকশনের সূচনা তার হাত ধরেই।

সাহিত্য থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও তার সমান তালে পথ চলা। লেখক হিসেবে যেমন জননন্দিত, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার আবার নাট্য-চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেও কিংবদন্তি। লেখক, নির্মাতা ছাড়াও হুমায়ূন আহমেদ গীতিকার হিসেবেও মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। রচনা করেছেন বেশকিছু গান। যার কোনো কোনোটি শ্রোতার হৃদয়ে দাগ কেটেছে আবার কোনো কোনোটি হয়ে উঠেছে হুমায়ূনের নিজের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

পেশায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপক। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। নিজের উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’, ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ প্রভৃতি। ‘আগুনের পরশমণি’, ‘দারুচিনি দ্বীপ’ ও ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ চলচ্চিত্রের জন্য বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বহু পদকে ভূষিত হয়েছেন তিনি।

ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় বাংলার কিংবদন্তি এই লেখকের। ওই বছরের ২৩ জুলাই তার মরদেহ আনা হয় দেশে। পরদিন নুহাশপল্লীর বৃষ্টিবিলাসের পাশে সমাহিত করা হয়।

শীতের কুয়াশা উপেক্ষা করেই শনিবার সকাল থেকে নুহাশপল্লীতে আসতে থাকেন নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের ভক্তরা। সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান লেখক, সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।

লেখকের প্রতি ভালোবাসার টানেই দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন বলে জানান ভক্তরা। যানজট ও ভোগান্তি ছাপিয়ে অনেক প্রকাশক, শিল্পীও শ্রদ্ধা জানাতে যান নুহাশপল্লীতে। সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান লেখকের স্ত্রী-অভিনয়শিল্পী মেহের আফরোজ শাওন এবং তার দুই ছেলে নিষাদ ও নিনিত। এরপর হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনের কেক কাটা হয়।

শিল্পকর্ম প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ দিনব্যাপী চলে নানা আয়োজন। বরাবরের মতোই হুমায়ূন আহমেদের ভক্তদের সংগঠন হিমু পরিবহনের সদস্যরা এতে যোগ দেন হলুদ পাঞ্জাবি পরে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: Content is protected !!