এত বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী বর্তমানে কোথায়

 

নিজস্ব রিপোর্টার:

মাঠে কোথাও এখন বিএনপি-জামায়াতের কর্মীদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মাঠ থেকে হঠাৎ করেই বিএনপি-জামায়াতের কর্মী-সমর্থকরা উধাও হয়ে গেছেন। গত চার বছরে, বিশেষ করে সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের পর কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত নেতাদের পাওয়া গেলেও কর্মী-সমর্থকদের খবর নেই। অনেকেই মিলেমিশে একাকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে।

আবার কেউ কেউ নিজেরাই আওয়ামী লীগ কর্মী সেজে ব্যবসা-বাণিজ্য ও নানামুখী কর্মকাে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলে নিজেদের সরকার সমর্থক হিসেবে জাহির করছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশ দেখে বদলে গেছে সবাই।

সুবিধাভোগীরা নতুন করে দল বদল করে নিজেদের অন্যরূপে উপস্থাপন করছেন। বাস্তবতার কারণে অনেক আওয়ামী লীগের মাঠের কর্মী ক্ষুব্ধ হলেও এখন কেউ আর কিছু বলছেন না। আবার হামলা-মামলার শিকার অনেক বিএনপি-জামায়াত কর্মী-সমর্থক তৃণমূল ছেড়ে শহরে এসে সরকারি দলের কর্মী বনে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনে দেখা গেছে ছাত্রলীগের ভিতর থেকেই ভোট দিয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশের অভিযোগ পুরনো।

একইভাবে পেশাজীবীদের মধ্যেও হঠাৎ আওয়ামী লীগ বনে যাওয়ার উৎসব তৈরি হয়েছে। পেশাজীবীরা, অতীতে যারা বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে কট্টর অবস্থানে ছিলেন, তারাও এখন টিভি টকশোতে এসে সরকারের গুণকীর্তনে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন। এ ক্ষেত্রে জাসদ ও কমিউনিস্ট পার্টির একসময়ের সমর্থকরা এখন সবচেয়ে এগিয়ে। সবাই এখন আওয়ামী লীগ বনে যাওয়ার কঠিন প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। কেউ কেউ নিজেদের প্রতিষ্ঠানে আওয়ামী ঘরানার দু-একজন রেখে তাদের পক্ষে অবস্থান তৈরি করছেন সরকারের প্রভাবশালী মহলে।

আওয়ামী লীগের একজন মাঠপর্যায়ের প্রবীণ নেতার মতে, এখন কোথাও কোনো বিএনপি-জামায়াত দেখা যায় না। সবাই এখন আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতীতে এত আওয়ামী লীগ আর কখনো দেখা যায়নি। জানা যায়, কয়েক বছর ধরে সারা দেশে আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী নেতা জামায়াতের নেতা-কর্মীদের ঠাঁই দিয়েছেন তাদের দলে। ফুলের তোড়ার সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের হাস্যোজ্জ্বল ছবিও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। দল শক্তিশালী করতে কেন্দ্রের নির্দেশ উপেক্ষা করে এ কাজ করেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এদিকে জামায়াতে ইসলামীও হামলা-মামলা ও গ্রেফতার এড়াতে নানামুখী কৌশল নিয়েছে। তারা চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিদেশে পাড়ি জমানো, বিভিন্ন ছদ্মবেশে অবস্থান করছেন ঢাকাসহ সারা দেশে। নানা প্রক্রিয়ায় জামায়াত-শিবির-বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশের পর অনেকে পদ-পদবিও বাগিয়ে নিচ্ছেন। বর্তমানে ঢালাওভাবে এ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকলেও এরই মধ্যে যারা যোগ দিয়েছেন, তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে বসে পড়েছেন। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলায় বিএনপি-জামায়াতের হাজার হাজার নেতা-কর্মী আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগদান করলেও তারা প্রকৃৃতপক্ষে সরকারের পক্ষে কাজ করছেন না। নিজেদের ‘এজেন্ডা’ বাস্তবায়ন করতে সরকারি দলে খুঁটি গাড়ছেন তারা। সরকারবিরোধী আন্দোলনে মামলা-হামলা ও গ্রেফতার এড়াতে এসব নেতা-কর্মী দল ত্যাগ করে সরকারি দলে ভিড় করছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করে নিজেদের পিঠ বাঁচিয়ে চলছেন এসব সুবিধাভোগী বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মী।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লেখক ও বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রে সমাজের সর্বস্তরে নানা দল ও মতের সমর্থক মানুষ থাকবে। প্রশাসন, শিক্ষা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন দল-মতের মানুষ থাকাই স্বাভাবিক। আমাদের দেশে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক হওয়ার একটা প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে। এটা স্বাধীনতার পর সব সরকারের আমলেই দেখেছি। একসময় প্রশাসন ও শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনে জিয়াউর রহমানের বিপুল সমর্থক ছিলেন। এরপর জেনারেল এরশাদের সময় তার দলের বহু সমর্থক ছিলেন। ’

তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি পুরনো দল। এই দলে সারা দেশে অবিচল সমর্থক ও বঙ্গবন্ধুর বহু অনুুসারী রয়েছেন। তারা জিয়া, এরশাদ বা খালেদা জিয়ার সরকারের সময়ও ছিলেন। কিন্তু তারা আওয়ামী লীগেরই ছিলেন। তারাই প্রকৃত অর্থে দলের বন্ধু। নকল সমর্থকরা তাদের এখন একপাশে ঠেলে দিয়েছেন। বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের সময় থেকে একটি সুবিধাবাদী শ্রেণি স্বঘোষিত আওয়ামী লীগ সমর্থক হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে দাস্য মনোবৃত্তিসম্পন্ন মানুষই বেশি। সবাই আওয়ামী লীগ হয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের জন্য একসময় বড় ক্ষতির কারণ হবে। এরাই প্রতারক। এরাই সরকারের ক্ষতি করবে। অসাধু সমর্থকদের সংখ্যা বাড়ার কারণে দল দুর্বল হবে এবং ত্যাগী একটি ঐতিহ্যবাহী বড় দল দুর্বল হলে গণতন্ত্রের জন্যও বড় ক্ষতি। ’ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘তৃণমূলে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যারা জড়িত, তারা দেখছেন দলটির ভবিষ্যৎ নেই। শিগগিরই আওয়ামী লীগ থেকে অন্য কারও হাতে ক্ষমতা যাওয়ার আশঙ্কা নেই। তাই তারা নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য আওয়ামী লীগে যোগদান করছেন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও তাদের বরণ করে নিচ্ছেন। ’ তিনি বলেন, ‘আগে মানুষ আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করত। এখন সেই আদর্শের ভিত্তিতে রাজনীতি কমে গেছে। এখন রাজনীতি হয় ক্ষমতাকেন্দ্রিক। যেদিকে ক্ষমতা সেদিকে সবার ঝোঁক থাকে। সে কারণে দেশে এখন বিএনপি-জামায়াত কমে গেছে। সবাই আওয়ামী লীগ সাজার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ সুবিধা নিতেও ক্ষমতাসীন দলে ভিড়েছে, যা আওয়ামী লীগের জন্য সুখকর নয়। ’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: Content is protected !!