ভদ্রলোকের স্বরূপ ঃপ্রফেসর মোঃ হুমায়ুন কবির চৌধুরী 

(১) আজকাল আমাদের সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় এত চরম পঁর্যায়ে পৌঁছেছে যে সামান্য ভদ্রতাজ্ঞানটুকুও আমরা দেখাতে কুন্টিত হই। কিন্তু এটি যে পরোক্ষভাবে যিনি প্রদর্শন করেন তারই অবমূল্যায়ন, তা তিনি বুঝতে কিংবা উপলব্দি করতে চান না। কথায় বলে ‘courtesy costs nothing’ ভদ্রতা বা সৌজন্যতা বা শিষ্টাচার দেখাতে পয়সা লাগেনা। অথচ এখানেই আমরা সবচেয়ে বড় কৃপণতা দেখাই, যা ব্যক্তি পরিবার এমন কী সমাজেরও সুনাম ক্ষুন্ন করে।

প্রেসিডেন্ট জনসনের ভদ্রতা জিনিসটা মোটেই পছন্দের ছিল না। এ কথা শোনলে হয়তো অবাক হতে হয় তবু, তিনি ভদ্রতার পরিচয় দিতেন,যা শোনলে বিস্মিত হতে হয়। আসলে রহস্যটা অন্য জায়গায়। যে ভদ্রতার মনের সঙ্গে যোগ নেই, তাই হয়তো তিনি পছন্দ করতেন না । আবার আমাদের সমাজে অন্যটাও দেখা যায় । যিনি অভাব ও দুর্দশাগ্রস্থ তাকে সবচেয়ে বেশি ভদ্র আচরণ করতে দেখা যায়। কিন্তু মনীষীদের মতে , অভাব ও দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের ভদ্রতাও অনেকসময় সাচ্চা হয় না। কারণ স্বাধীন ,মুক্ত ও ব্যক্তিত্ববান মানুষের ভদ্রতাই প্রকৃত ভদ্রতা। দরিদ্রর পক্ষে ভদ্র না হয়ে উপায় কী ? দুর্বল বা অনুগ্রহদগ্ধ,জীবনের পক্ষে বিনয়ে বিচালিত হওয়ার বিকল্প আছে কী ? স্যার হেনরী সিডনী তারপুত্র ফিলিপ সিডনীকে বলেছিলেন ,তুমি বড় বংশে জন্মেছ,বিনয় ও চরিত্র মহিমায় তোমাকে তা প্রমাণ করতে হবে।
তোমর সৎস্বভাব,তোমার বিনয় নম্র ব্যবহার,তোমার সত্যপ্রীতি তোমার উচ্চকুলের পরিচয় দেবে। পিতার নাম করে যেন তোমাকে বড় বংশের লোক বলে পরিচয় দিতে না হয়। প্রকৃত অর্থে ভদ্রতার প্রধান উপাদান ত্যাগ । পরের জন্য ত্যাগ স্বীকার ,নিজের মুখের সঙ্গে সঙ্গে পরের মুখের প্রতি দৃষ্টি রাখা পরকে আঘাত না দেয়া ,অর্থ দিয়ে হোক বা পরিশ্রম করে এমন কী হিতোপদেশ দিয়ে অন্যকে সাহায্য করার নাম ভদ্রতা।

কিন্তু আমদের সমাজে স্বার্থপরতার কারণেই নূন্যতম ভদ্রতাজ্ঞানটুকুও অনেক সময় আমরা হারিয়ে ফেলি। যেটি কেবল হিংসা বিদ্বেষেরই জন্ম দেয়। ভদ্র-ঘরের ছেলেই যে ভদ্র হয় এমন কোন নিয়ম নেই।

(২) যে ছোট হয়ে পড়ে আছে, সে হয়তো ছোট নয়। তার মধ্যে কত মানুষত্ব,কত মাধুরী ঘুমিয়ে আছে তা হয়তো অন্যরা নাও জানতে পারে; সুবিধা ও সুযোগ পেলে সেও মানব সমাজে সম্মান পেত। ভদ্র লোক যিনি সহজে রাগ করেন না,কোন কারণে মনে কষ্ট পেলেও শতবার ভেবে দেখেন,তার কোন অপরাধ হয়েছে কিনা; কারণ একজন ভদ্রলোকের মানুষকে ব্যথা দেওয়া তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ।
ভদ্র লোকের কথা খুবই মধুর,স্বভাব অতি অমায়িক,নিজের ক্ষতি হলেও ওয়াদা রক্ষা করেন। গীবত করা তার পক্ষে খুবই কঠিন। তিনি সাধ্যমত কারো কাছে কোন কিছু প্রার্থনা করেন না। সর্বদা প্রতিবেশি বন্ধুবান্ধবও আত্মীয় স্বজনের খোঁজ-খবর নেওয়া তার চরিত্রের অন্যতম অর্জন। ভদ্রলোক সর্বদাই পরম করুণাময় আল্লাহর উপর নিরর্ভরশীল হতে চান। মানুষের মন খুশি করার জন্য কারো সাথে অন্যায় আচরন করেন না। সৎসাহস তার চরিত্রের অমূল্য সম্পদ। ছোট বড় নির্বিশেষে সবার সাথে তিনি ভদ্র আচরণ করেন । হযরত মুহাম্মদ (দঃ) যে এত মানুষকে মুসলমান করেছিলেন তার অন্তনিহীত কারণ ভদ্রতা। তার মানুষত্ব তার আশ্চর্য ভদ্রতা মানুষের মনকে মুগ্ধ করে দিতো। বস্তুত হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর জীবন তার ভদ্রতা ছিল আশ্চর্য জিনিস। তার স্নেহ,তার সহনীয় ক্ষমতা, তার স্বভাবের অনন্ত মাধুরী মানুষকে সম্মোহিত করত ।

শুধু মুখের কথার মধ্যেই ভদ্রতা নিবদ্ধ নয়। ভদ্রলোক সর্বদাই সহৃদয় ও স্নেহশীল । ভদ্রলোকের ব্যবহার দেখেই বুঝতে পারা যায়,তিনি কত উচ্চস্তরের লোক। তার কথা ও কাজ সর্বদাই সুন্দর। তিনি ধর্ম জীবনকেও আলাদা করে ভাবেন না। এক শ্রেনীর লোক আছেন যারা ধর্ম জীবনকে নিজের কথা ও কাজ হতে স্বতন্ত্র করে গ্রহণ করতে চান। ধর্মজীবন অর্থ শুধু উপাসনা নয়। ভদ্রতা,শিষ্টাচার বজায় রেখে মানুষের সহিত নির্মল মধুর ব্যবহারও ধর্মীয় আচারের আদব।

ভদ্রলোক যিনি,ভদ্রলেকের সম্মান বুঝে থাকেন । ভদ্রলোক যেমন নিজের সম্মানবোধ সম্পর্কে সচেতন ,অন্যের সম্মান ঠিক তেমন করে উপলব্দি করেন। তার সম্মুখে যদি কোন ভদ্রলোকের অপমান হয়, তিনি নীরবে তা সহ্য করতে পারেন না। বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও ভদ্রলোক ভদ্রলোকের বন্ধু। মুহুর্তের মাঝে তাদের মধ্যে পরিচয় হয়ে যায়। একন্ত আপনার হলেও যে নীচ ও দুর্বৃও ভদ্রলোক তাকে আপনার বলে স্বীকার করতে চান না । নিজের অসুবিধা হলেও ভদ্রলোক ভদ্রলোকের সুবিধা করে দিতে আনন্দবোধ করেন।

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর(রা:) যেইমাত্র ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলেন, তখন রাজাসনের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি জনতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন আমার চেয়েও যদি কোন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সন্ধান আপনারা পান,তবে তাকেই সিংহাসনে বরণ করে নিন। আপনাদের আদেশ আজ আমি মাথা পেতে নিলাম , কিন্তু যখনই উপযুক্ত ব্যক্তির সন্ধান পাবেন তখন যেন আমাকে বাদ দেওয়া হয়।

(৩) হযরত আলী (রাঃ) ছিলেন একজন আর্দশ ভদ্রলোক। তার মধ্যে যে মহত্ব,মনুষত্বের গরিমা ছিলনা তা আজও তুলনাবিহীন। মনীষীর ভাষায় ,ভদ্রলোক সবসময়ই ভদ্র । তিনি মানুষকে শ্রদ্ধা করতে ভালবাসেন । তার মুখের স্থির গাম্ভীর্য,তার দৃষ্টি,তাঁর কথার যাদুকরী ভঙ্গি মানুষকে সম্মোহিত করে তোলে। তিনি উগ্র কঠিন হয়ে কারো কাজের সমালোচনা করেন না, তার স্পর্শ,তার সঙ্গ আত্মার ওপর মহত্বের দ্যুতি ছড়াতে থাকে। তাঁর হাসিটুকু মানুষের মনে স্বর্গের কিরণ এনে দেয়। ভদ্রলোক কখনও কাপুরুষ নন, অথচ তাঁর তেজ কখনও উগ্র ভীষণ হয়ে দেখা দেয় না। তিনি বিপদে ধৈর্য ধারণ করেন,ঝঞ্জার মাঝে তিনি আশা,আনন্দ ও শক্তির অমৃত বর্ষণ করেন। ভদ্রলোক কখনও নীচ নন । মনের স্বাধীনতা রক্ষা করতে তিনি সদাই ব্যগ্র। মনের স্বাধীনতা যেখানে থাকে না ,সেখানে তিনি অগ্রসর হন না। তার বহু টাকা ক্ষতি হয়ে যাক, তার জীবনে দুঃখের মাত্রা বেড়ে উঠুক , অভাবের বেদনা তাকে চেপে ধরুক,তবুও তিনি তার চিত্তের অবমাননা সহ্য করতে পারেন না। ভদ্রলোক জ্ঞানের সেবক।

দেশ বিদেশের ঘটনাপ্রবাহ, চিন্তশীল ব্যক্তিরা কী নতুন কথা বলেছেন এসব জানার জন্য তার মনে ব্যাকুলতা থাকবেই। বই পড়া ,দেশের খবর রাখা ভদ্রলোকেরই স্বরূপ। আজকাল আমাদের সমাজের একটি বাতিক হল শীতকালে বা কোন উৎসবে অর

অর্থ বস্ত্র দান করা। কিন্তু ভদ্রলোক দরিদ্রও দুঃখী মানুষকে অর্থদান করেন নামের জন্য নয়। দয়া প্রর্দশনে অথবা দান কার্যে অত্যাধিক হিসাব ও তর্ক করা ভদ্রতা নয়। ভদ্রলোক বাড়ির অবোধ প্রানির প্রতিও সহানুভুতিশীল। নিষ্ঠুরতা বা অন্যের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন তার স্বভাবে নেই। তিনি যেমন নিজের সুখ সুবিধার প্রতি মনোযোগী ;অন্যের প্রতিও সমান মনোযোগী।
আজকাল আমদের সমাজে অভদ্রতাই যেন ভদ্রতা । আমাদের মূল্যবোধ এত নীচে নেমেছে যে সন্তান, বাবা-মা-শিক্ষকের কথার গুরুত্ব না দিয়ে অদৃশ্য বড় ভাইর কথা সবচেয়ে বেশি মানেন। বড় ভাই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মত সুরে সুরে বাঁশি বাজিয়ে তাদেরকে অক্ষয়ের অতল গহবরে নিয়ে যান। সেই সুরে বিমোহিত হয়ে তারা ভদ্রজ্ঞানটুকু ও হারিয়ে ফেলেন। ভদ্রতা এমন একটি গুণ যা পারিবারিক সুত্রে নয়, এটি সাধনাবলে অর্জন করতে হয় ।

লেখক : প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ,সিলেট এম.সি.কলেজ।

সহায়ক গ্রন্থ : উন্নত জীবন- ডা. লুৎফর রহমান
মহৎজীবন- ডা. লুৎফর রহমান।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: Content is protected !!